(১)
ছেলেটি স্কুলে যায় না। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে কার বাড়ির উঠোনে রোদে আচার দেওয়া আছে তার খবর রাখতে ব্যস্ত থাকে। একবার আচারের বয়াম পেলে হল। নিমেষে সেটা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে। আচার মাখিয়ে রুটি খেতে বড় ভালোবাসে ছেলেটি !
ছেলেটার নাম শিবু। কিন্তু তার আচার চোর হিসেবে বদনাম আছে বলে সবাই তাকে শিবাচার নামেই ডাকে। পড়াশোনা হয়নি বলে ছেলেটিকে নিজের খাবার জোগাড় করতে গিয়ে চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়। নানান লোকের নানা রকম ফাইফরমাস খাটার কাজও করে সে।
শিবাচারদের গ্রাম কোটালডি থেকে মাইল খানেকের মধ্যেই একটা ঘন জঙ্গল আছে। তার কিছুটা দূরে দামোদর নদ বয়ে চলেছে পঞ্চকোট পাহাড়কে বেষ্টন করে। একদিন সেই জঙ্গলের পথে হাঁটতে হাঁটতে শিবাচার দেখল কয়েকটি লোক লরী থেকে পীঠে ভারী বস্তা চাপিয়ে অন্য একটি স্থানে জমা করে রাখছে। শিবাচার পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে হাজির হল।
মাথায় একটা লাল রং-এর গামছা বেশ শক্ত করে বেঁধে রেখেছে একটা লোক। লোকটি শিবুকে একবার দেখল কিন্তু কিছুই বলল না। দলের অন্য লোকদের তাড়া দিয়ে বলল, “যে ক-টা বস্তা লরীতে পড়ে আছে সব এখানে এনে জমা করা রাখ। আমি রেললাইনের ও পাশটায় নজর রাখছি।”
লোকগুলো দৌড়াতে দৌড়াতে মালভর্তি বস্তা আনতে চলে গেল। সমস্ত মালপত্র জমা করা হয়ে গেলে দলপতি গোছের লোকটি শিবুর দিকে ভালো করে নজর দিল। তারপর অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে পকেট থেকে একটা হুইশেল বের করে শিবুর হাতে দিয়ে বলল, “এই বস্তাগুলোর দিকে নজর রাখবি। আমরা ছাড়া অন্য কাউকে এই জঙ্গলে ঢুকতে দেখলেই হুইশেল বাজাবি। মনে থাকবে ?”
শিবু দলপতির নির্দেশমতো বলল, “হ্যাঁ, বাজাব।”
তার কথা শেষ হতে না হতেই দলপতি সহ সবাই জঙ্গলের পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
লোকগুলো কোথায় গেল শিবু কিছুই বুঝতে পারল না। সে ধীরে ধীরে জমা করে রাখা বস্তাগুলোর কাছে এসে দাঁড়াল।
“কী আছে বস্তার মধ্যে ?” শিবু উবু হয়ে বসে দেখতে লাগল। ঠিক তখনই দূরে একটা জিপগাড়ির শব্দ শোনা গেল। গাড়িটা স্টার্ট বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু শিবুর কাছ থেকে ঠিক কতটা দূরে দাঁড়াল সেটা এই জঙ্গলের ফাঁক ফোকরে নজর পড়ছে না। শিবু তরতর করে একটা করঞ্জ গাছ বেয়ে উপরে উঠে গেল। আর তখনই দেখতে পেল কয়েকটি লোক ইতস্ততঃ ঘুরে কোন কিছুর সন্ধান করছে।
“এরা কি পুলিশের লোক?” শিবু নিজের মনেই প্রশ্ন করল। এবার তার মনে পড়ল দলপতি তাকে হুইশেল বাজিয়ে সতর্ক করে দিতে বলেছিল। সে পকেট থেকে হুইশেল বের করে সেটা বাজাতে গিয়েও বাজাল না। কেননা লোকগুলো বাঁশির শব্দে এদিকেই চলে আসতে পারে। তাছাড়া জঙ্গলের মাঝে বস্তাগুলোর খবরও তো তারা পেয়ে যাবে অনায়াসে। শিবু করঞ্জ গাছের ডার ধরে চুপ করে বসে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ সেইভাবে গাছে সেঁটে থাকার পর একসময় সে জিপগাড়িটাকে স্টার্ট নিয়ে চলে যেতে শুনল। নিশ্চিন্ত হয়ে শিবু আবার নীচে নেমে এল। আর তখনই সে দেখতে পেল দলপতি একটা ঝোপের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
শিবু দলপতির হাতে হুইশেলটা ফেরত দিতে গেল। কিন্তু দলপতি বলল, “ওরা পুলিশের লোক ছিল। আর একটু হলেই আমাদের মালপত্রের খোঁজ পেয়ে যেত। বাঁশিটা তোর পকেটেই এখন রেখে দে।” এই বলে দলপতি একটা বস্তার উপর বসে পড়ল।
শিবু বলল, “এই বস্তার মধ্যে কী আছে ? এগুলোকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে কেন ?”
সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে দলপতি শিবুর দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, “কোন গ্রামে থাকিস?”
“কোটালডি।”
“বাড়িতে আর কে কে আছে ? কোটালডির আচার্য পাড়ার হারাধন আচার্যকে চিনিস ?”
শিবু বলল, “হারাধন আচার্যর বাড়ির কাছেই তো আমাদের বাড়ি ছিল। তবে বেশ কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িটা বর্ষার জলে মাটি গলে গলে পড়ে গেছে। আর সারানো হয়নি। এখন আমার কোন বাড়ি নেই। গ্রামে এর বাড়ির বারান্দা ওর বাড়ির মাটির দাওয়ায় শুয়ে রাত কাটাই।”
দলপতি বলল, “বুঝলাম।” এই বলে উঠে পড়ল সে। তারপর বস্তাগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল।
শিবু জায়গাটার আশে পাশে বেশ কিছু চাল, চিনি, মশুরির ডাল পড়ে থাকতে দেখল। লোকগুলো যখন দমাস দমাস করে বস্তাগুলো ফেলছিল তখন কিছু চাল-ডাল এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে।
(২)
রাত তখন এগারোটা কী সাড়ে এগারোটা। একটা জোরালো টর্চ লাইটের আলো চোখে পড়তেই শিবুর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সে শুয়েছিল একটা চালের বস্তার উপর। দু-তিনজন লোক অন্ধকারে টর্চ লাইট নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। দলপতির কথাও কানে আসছে।
কেউ একজন বলল, “ছোঁড়াটা কে ? এখানে জুটলো কেমন করে, বাইরে আমাদের খবর ছড়িয়ে দেবে না তো ?”
দলপতি বলল, “আরে না না। ওকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। ও খুব ভালো ছেলে। আমাদের কথা মতো কাজ করবে। আর তাছাড়া ও আমাদের ডেরা ছেড়ে বাইরে যাবেই বা কেন? ওকে আমি আমার কাছেই রাখবো সবসময়।” তাকে নিয়ে আর কেউ কিছু কথা বলল না।
আরেকটা লোক শিবুকে নিয়ে চলল একটা গাছের মহুল গাছের নীচে। সেই গাছটার ঠিক মাথার উপরেই আধখানা চাঁদ। সেই গাছের পাতা ভেদ করে হালকা চাঁদের আলো এসে পড়ছে নীচে। গাছের চারপাশটা নজর চালিয়ে বোঝা যাচ্ছে এখানে রোজ রাত্রেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয়। বেশ কয়েকটি চৌকো মতো পাথর সার দিয়ে মাটিতে বসিয়ে রাখা আছে। দলপতি আর শিবু পাশাপাশি খেতে বসল। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর ঝোল ঝোল আলু পোস্ত। সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা পেঁয়াজ আর আচার। শিবু তো আচার খুবই ভালোবাসে। তাছাড়া তার খিদেটাও পেয়েছিল বেশ। সবার আগে গোগ্রাসে সে অনেকটা গরম ভাত সাবাড় করে ফেলল।
দলপতি বলল, “খেয়ে দেয়ে আমরা একটু কাজে বের হব।”
কথাগুলো সে শিবুর দিকে তাকিয়েই বলল। শিবু এক গ্লাস জল ঢক ঢক করে খেয়ে চুপচাপ বসে ভাবতে লাগল। এরা কি রাত্রে ডাকাতি করতে বেরোবে ? নিশ্চয়ই হাতে বন্দুক-পিস্তল থাকবে। শিবু শুনেছে ডাকাতরা রাত্রে চাল-চিনি বোঝাই মালগাড়ি থামিয়ে বন্দুক ঠেকিয়ে বগি থেকে সব জোর করে নামিয়ে নেয়। একবার শিবু তাদের পাশের গ্রাম কিনাইডির একটা পুকুরের জলে স্নান করতে গিয়ে অনেকগুলো সাবান কুড়িয়ে পেয়েছিল। সাবানগুলো রাত্রে কেউ জলে ফেলে দেয়। যদিও সকাল বেলা সেই সাবানের অনেকটাই গলে গিয়েছিল কিন্তু সেই গলে যাওয়া সাবান খুঁজতেই গ্রামের লোক দলে দলে জলে নেমে পড়েছিল। শিবু শুনেছিল ডাকাতের দল মালগাড়ি বোঝাই জিনিসপত্র চুরি করে পালাচ্ছিল। সে সময় পুলিশ তাড়া করলে ডাকাতরা সমস্ত সাবানের বাক্স জলে ফেলে পালায়। এমনকি একবার একটি ছোট্ট পুকুরে ডাকাতরা বস্তা বস্তা চোরাই চিনি ফেলে দিতে পুরো পুকুরের জলটাই মিষ্টি হয়ে গিয়েছিল।
ঠিক যখন রাত বারোটা তখন দলপতি পাঁচজন সঙ্গীর মাথায় ছোট ছোট চাল-ডালের বস্তা চাপিয়ে হাঁটা শুরু করল। দলপতি আর শিবুর হাত খালি। চাঁদের আলোয় মাঠ ভেঙ্গে হেঁটে চলেছে শিবু। গভীর রাত্রে আলো ছাড়া হাঁটার অভ্যেস নেই তার। তাই বার বার হোঁচট খাচ্ছে। দলপতি চলেছে সবার আগে আগে। শিবু নিজের মনে ভাবতে লাগল, “আজ সেও একজন ডাকাত তবে সে খুদে ডাকাত। আচ্ছা কোন বড়লোকের বাড়িতে কি ডাকাতি হবে ? বড়লোকদের বাড়িতে ঢোকা কি এতই সোজা ! তাদের বাড়িতে বন্দুকধারী পাহারাদারও তো থাকতে পারে। তখন ?”
এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছে শিবু। পুরো দলটি এরপর একটা ছোটখাটো জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। জঙ্গলে ঢুকতেই দলপতি পকেট থেকে একটা জোরালো পাওয়ারের টর্চ বের করল। শিবু সহ সকলকে এগিয়ে দিয়ে সে পিছনে টর্চ হাতে হাঁটতে লাগল। দু-একটা শেয়াল দ্রুত পথ কেটে পালিয়ে গেল। একবার একটা খরগোশকেও দেখতে পেল শিবু। এগুলো নিশ্চয়ই বুনো খরগোস।
জঙ্গলের ঠান্ডা হাওয়া শিবুর পথ চলার ক্লান্তি অনেকটা কমে এল। এতক্ষণ পরে হঠাৎ তার মাথায় একটা প্রশ্ন দেখা দিল, “আচ্ছা তারা তো ডাকাতি করতে যাচ্ছে, কিন্তু লোকগুলোর মাথায় চাল-ডালের পুঁটুলি কেন ?”
ভাবতে ভাবতে জঙ্গলের পথ ফুরিয়ে গেল। শিবু দেখল খুব সামনেই দু-তিনটি টিলা আর তার নীচে অনেকগুলি টালি আর খড় দেওয়া মাটির ঘর। একটি ঝাপুড়-ঝুপুড় বট গাছের নীচে কয়েকটি দড়ির খাটিয়া পাতা। তাতে দু-তিন জন লোক চুপচাপ বসে রয়েছে।
দলপতিকে দেখেই তারা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। দলপতি বলল, “মাধব কোথায় ?”
মাধব নামের লোকটি সামনে এগিয়ে এসে বলল, “এই যে আমি। সবার বাড়িতে খবরটা দিয়ে রেখেছি। নাও এখন সকলে একটু জল-বাতাসা খেয়ে নাও।” তারপর শিবুর দিকে নজর পড়তেই অবাক হয়ে বলল, “এই ছেলেটিকে কোথায় পাওয়া গেল ?”
দলপতি বলল, “ও শিবু। ভাল নাম শিবাচার। ওকে দেখে খুব সাহসী মনে হয়।”
মাধব এর উত্তরে কিছু বলল না। সবজি খেতের আল দিয়ে লাইন করে ওরা হাঁটতে লাগল। বেশ উঁচু-নীচু পথ। সবশেষে একটা পুকুরের পাড় পার হয়ে ওরা হত-দরিদ্র একটা গ্রামে এসে উদয় হল। এটাকে কি গ্রাম বলা চলে ? বরং টোলা বললেই ভালো হয়।
শিবু বেশ বুঝতে পেরেছে এই টোলাতে দলপতির আর যাই কাজ থাক চুরি-ডাকাতি সংক্রান্ত কোন কাজ থাকতে পারে না। মাথায় বস্তা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকগুলো ঘেমে গেছে। চাঁদের আলো গায়ে লেগে তাদের দেহগুলো চক্ চক্ করছে। এই লোকগুলোই যদি মাথার বোঝা নামিয়ে হাতে মশাল নিয়ে হা-রে-রে-রে করে ডেকে ওঠে তবে যে কারোর দাঁত কপাটি লেগে যাবে। তবে বাস্তবে সে রকম কিছু ঘটার বদলে যা ঘটল তাতে শিবু কম অবাক হল না। রাত-বিরেতে টোলা থেকে মাধব জনা পঁচিশেক অত্যন্ত গরিব লোকদের ধরে নিয়ে এল। তারপর দলপতির কথামতো বস্তার চাল-ডাল সব ঢেলে দেওয়া হল তাদের ছোট ছোট থলির মধ্যে। শিবু দূর থেকেই দেখতে পেল খেতে না পাওয়া গ্রামবাসীদের চোখগুলো আনন্দে চিক্ চিক্ করে উঠল। তারা মহানন্দে সেই চালের পোঁটলা মাথায় চাপিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শিবু এখন বেশ বুঝতে পেরেছে এরা সেরকম ডাকাত নয়। বরং বলা যেতে পারে এরা গরিবের বন্ধু। রেলের ওয়াগন ভেঙে রাতের অন্ধকারে এরা শুধু চাল-ডাল-চিনি এসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া অন্য কিছু চুরি-ডাকাতি করতে যায় না। সোনা-দানা বা টিভি ফ্রিজে এদের কোন লোভ নেই। আর থাকবেই কেন ? চুরি করার উদ্দেশ্য তো কিছু মানুষের উপকার করা। যারা দু-বেলা দু-মুঠো খাবার জোগাড় করতে পারে না এরা তাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়। তাই সোনা-দানায় হবেটা কী ?
দলপতির নাম বীরু। সবাই বীরুদা বলেই ডাকে। শিবুও বীরুদা বলে। বীরুদার গালে গালপট্টি নেই। রাতের বেলা ডাকাতি করতে যাবার আগে কানে রক্ত-জবা গুঁজে কালী মন্দিরে পুজোও দেয় না সে। বীরুদার সাজ-পোষাক বা কথাবার্তা একেবারেই সোজা সাপটা। তাকে স্কুলের মাস্টারমশাই বললেও চলে।
(৩)
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। শিবুরা পঞ্চকোট পাহাড়ের উপরে একটা ভেঙে পড়া গড়ের আড়ালে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে। আজ শিবুও বীরুদার সাথে রাত্রে বের হবে এরকমটিই ঠিক হয়ে আছে। রামকানালী আর বৃন্দাবনপুর রেল-ইয়ার্ডের মাঝে দুটো গম ভর্তি মালগাড়ি এসে পৌঁছাবে বলে খবর আছে। রামকানালী রেল স্টেশন ঢোকার মুখে প্রতিটি মাল গাড়িই কোন এক অজানা কারণে দাঁড়িয়ে পড়ে। বীরুদের দল এটা বেশ ভালোই জানে।
দশটা বাজতেই বীরুদা নির্দেশ দিল, “আমাদের আর দেরি করা চলবে না। মুরাডির বনমালীকে খবর দেওয়া আছে। ও লরী নিয়ে জঙ্গলের মুখে অপেক্ষা করবে। আমরা সবাই রেল ইয়ার্ডের উত্তর দিকে যে খেজুর গাছটা আছে ওখানে অপেক্ষা করব।”
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সবাই শুনতে পেল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঝম্ ঝম্ করে একটা মালগাড়ি আসছে। বীরুদা বলল, “শিবু তুই হুইশেল নিয়ে স্টেশনের দিক থেকে কেউ আসছে কী না লক্ষ্য রাখবি।”
শিবু বলল, “ঠিক আছে।”
সবাই আলাদা আলাদা হয়ে রেল লাইনের কাছাকাছি ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ল। তারপর মালগাড়িটা থেমে যেতেই বীরু ঝটিতে বগির সিল খোলার কাজে লেগে গেল। এসব কাজে বীরুদা অত্যন্ত দক্ষ।
প্রায় তিরিশ-চল্লিশটা বড় বড় চাল বোঝাই বস্তা নীচে নামানো হয়েছে। বীরুদা বলল, “অনেক হয়েছে। এর চেয়ে বেশি নামাতে গেলে ডেরায় এ গুলোকে পৌঁছানো যাবে না।”
শিবু লক্ষ্য করল অন্ধকারে বেশ খানিকটা দূরে দু-জন লোক এগিয়ে আসছে ওরা কি রেল পুলিশের লোক ? তীর গতিতে শিবু ছুটে এল বীরুদার কাছে।
বীরুদা বলল, “তোরা সবাই গা ঢাকা দে। আমি এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। তেমন হলে ফায়ার করতে হতে পারে।”
সঙ্গী-সাথিরা এখানে ওখানে লুকিয়ে পড়ল। শিবু আবার চলে এল খেজুর গাছটার কাছে।
হঠাৎ দূর থেকে গুলির শব্দ শোনা গেল। পর পর তিনবার। তারপর বেশ কিছুক্ষণ আর কোন শব্দ নেই। একসময় মালগাড়িটা সিগন্যাল পেয়ে চলতে শুরু করল। ফাঁকা মাঠের মধ্যে চালের বস্তাগুলো বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল।
শিবু এসে দেখল বীরুদা সেই বস্তাগুলোর পাশে পড়ে রয়েছে। গুলিটা সোজা তার বুকে এসে লেগেছে। সে এবার হুইশেলটা বের করে পাগলের মতো একটানা বাজাতে লাগল।
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। শিবু তার বীরুদার মতো এখন পুরো গড়পঞ্চকোট পাহাড়টা একাই রাজত্ব করে। তার নাম শুনলে সেই অঞ্চলের সকলেই ভয়ে কেঁপে ওঠে। তবে মজার কথা হল শিবাচারকে চাক্ষুস কোনদিন দেখেনি কেউ। পাহাড় সন্নিকটের দরিদ্র গ্রামবাসীদের যে কোন দরকারে শিবাচারের দলবল ঠিক সময়ে পৌঁছে যায়। গ্রামবাসীরা তাই শিবাচারকে তাদের দেবাতর মতই শ্রদ্ধা করে।
এদিকে শিবাচারের নাম পুলিশের খাতায় উঠে বসে আছে। অনেকদিন ধরেই পলিশের উপর মহল শিবাচারকে পাকড়াও করার নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড় ও ডুংরি ঘেরা জায়গাটা জঙ্গলে পরিপূর্ণ। এখানের জঙ্গল বানাতে সরকারকে গাছ লাগাতে হয়না। আদিম প্রকৃতির বহুদিনের নিজস্ব গাছপালা এখানে বিরাজমান। সেই জঙ্গল ফুরিয়ে যাবার নয়। আর এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে একা রাজত্ব করে শিবু। তাকে ধরে ফেলা অত্যন্ত কঠিন কাজ। টিলার পাদদেশে যে সমস্ত ছোট ছোট বস্তিগুলো রয়েছে পুলিশ দিনে ও রাতে যখন তখন সেখানে যায় কিন্তু শিবাচারকে ধরিয়ে দেবে এরকম কাউকে পায়না।
রামচন্দ্রপুর গ্রাম পেরিয়ে দুটি পাহাড় চিরে একটা রাস্তা চলে গেছে হাঁটুমাঝেরডি গ্রামের দিকে। সেখান থেকে ডানপাশে কিছুটা গেলেই ভূতনাথ বাবার আশ্রম। ছোট্ট আশ্রমটিতে একজন সাধুবাবা আর তিন চারটি ছাগল ছাড়া আর কিছু নেই।
সেই ভূতনাথ বাবার আশ্রমে অতর্কিতে পুলিশের লোক হানা দিল এক রাত্রে।
সাধুবাবা গেরুয়া গায়ে দিয়ে ভেতরের ঘরে বসে ধ্যান করছিল।
পুলিশ বলল, “ভেতরে কে ? বাইরে আসুন।”
অন্ধকার ঘরের ভেতরে ছোট্ট একটি হ্যারিকেন বাতি। সেটার পলতে একটু বাড়িয়ে সাধুবাবা বাইরে এল। তারপর বেশ স্থির দৃষ্টি মেলে বলল, “বলুন কী বলবেন !”
পুলিশের বড়বাবু বললেন, “আপনি ডাকাত শিবাচারকে চেনেন?”
সাধুবাবা বলল, “কেন চিনবো না ? খুব চিনি ! রাত বিরেতে প্রায়ই আমার ডেরায় এসে আশ্রয় নেয় সে।”
“ওকে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিতে হবে আপনাকে। এটাই আমাদের নির্দেশ !”
“ডাকাত ধরিয়ে দেওয়া কি আমার কাজ ? সে কাজ তো করবেন আপনারা। এই যেমন আজ হঠাৎ এখানে হানা দিয়েছেন তেমনি সাহস থাকলে গভীর রাত্রিতে এসে ওকে ধরে নিয়ে যান আপনারা।”
পুলিশের বড়বাবু বেশ ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলেন সাধুবাবাকে। তারপর ভেতরে ঢুকে দেখলেন ঘরের মধ্যে একটি চৌকি পাতা আর চৌকির নীচে কয়েকটি ছাগল ছাড়া আর কিছুই নেই।
তিনি দলবল নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।
সাধুবাবা দরজা বন্ধ করে রাতের আহার করতে বসল। নিজের হাতে বানানো গরম রুটি আর আচার। আচার আর রুটি খেতে সে খুবই ভালোবাসে, সেই ছোটবেলা থেকেই !
তরুণকুমার সরখেল
পুরুলিয়া
