অজয়ের ভাষায়, অজয়ের বাবা ছিল বিশ্রী রকমের গরীব। অথচ ছোটো থেকেই অজয়ের কোটিপতি হবার শখ ছিল। ছোটোবেলায় অজয় তার পিসির কাছেই থাকতো। অজয়ের পিসেমশাই ছিলেন নিঃসন্তান বড়োলোক। শুধু বড়োলোক বললে ভুল বলা হবে। অজয়ের ভাষায়, পিসেমশাই ছিলেন ঘাবড়ে দেবার মতো বড়োলোক। অজয়ের পিসেমশাই-এর ছিল পাথরের ব্যবসা। শুধু ব্যবসাদার বললে কম বলা হবে; পাড়ার লোকেদের ভাষায়, পরিশ্রমী ব্যবসাদার। অজয় এই বড়োলোক পিসেমশাই-এর বাড়িতেই বড়ো হয়েছিল বটে তবে বড়োলোক হয়নি বহু বছর পর্যন্ত। এদিকে অজয়ের কোটিপতি হবার বেজায় শখ। আমি ছিলাম এই অজয়ের ক্লাস-ফ্রেন্ড।
ক্লাসে মাস্টারমশাইরা কে-কী হতে চাও জানতে চাইলেই অজয় বলতো, সে পাথরের ব্যবসা করতে চায়। ক্লাসের সকলে এটা শোনা মাত্রই হোহো করে হাসতো। একদিন অঙ্কের মাস্টারমশাই বিশ্বনাথবাবু অজয়কে জিজ্ঞেস করলেন, অজয়, কেন তুমি পাথরের ব্যবসা করতে চাও?
অজয়ের চটজলদি জবাব, আমার পিসেমশাই পাথরের ব্যবসা করে বড়োলোক হয়েছেন।
বিশ্বনাথবাবুও ছাড়বার পাত্র নন। আবার প্রশ্ন, কী পাথর? নীলা, হিরে, নাকি পান্না?
এবার অজয় মাথা চুলকে চোখ নামিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিল, স্টোনচিপস, স্যার। কথাটা বলামাত্রই গোটাক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল। বিশ্বনাথবাবুর শত চেষ্টাতেও সেই হাসির সোরগোল থামলো না। অঙ্কক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ল। বিশ্বনাথবাবু চলে যাতেই, সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। পরের ক্লাস শুরু হবার আগে অনেকেই ভুলে গেল কেন তারা হাসছিল, কিন্তু অজয় ভুলল না। স্কুলের খেলার মাঠের এক কোণে চুপ করে বসে রইল। আমরা যারা অজয়ের কাছের বন্ধু ওকে খুঁজে বার করে বুঝিয়ে টুঝিয়ে ক্লাসে আনতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু অজয়কে নড়ানো গেল না।
এর বেশ কিছুদিন পর, মানে কয়েক মাস পর একদিন অজয়ের পিসির বাড়ি গেছি। যাব না কেন? তার বেশ কিছুদিন আগে থেকে আমরা অজয়ের কাছের বন্ধুরা খেয়াল করলাম, অজয় যেন সবসময় কী নিয়ে ব্যস্ত। অনিয়মিত স্কুলে আসে। দেখা হলেই বলে, ব্যস্ত আছিরে, পরে কথা হবে। আর সঙ্গে সবসময় পাড়ার নেড়িকুত্তা কালুকে নিয়ে ঘোরে ।
কালুকে যে সাবান মাখিয়ে শ্যাম্পু দিয়ে রোজ স্নান করানো হয় তা ওর তেল চকচকে পালিশ করা কালো লোম দেখলেই বোঝা যেত। শীত পড়তেই দেখা গেল, কালুর গায়ে কোর্ট, পায়ে জুতো মোজা। গরমে কালুর জন্য টেবিল ফ্যান কিনেছে শুনলাম। পাড়ার বাপিদার চিকেনের দোকান থেকে রোজ কালুর জন্য মাংস বরাদ্দ। এসব শুনে সন্টি বলল, তবে কি অজয় সত্যি সত্যি বড়োলোক হয়ে গেল?
প্রথম প্রথম অজয়ের কান্ডকারখানার কথা এর ওর মুখে শুনে আমরা হাসাহাসি করতাম। কিন্তু অ্যানুয়াল পরীক্ষা এসে গেল অথচ অজয় স্কুলে আসার কথা মাথাতেই নিচ্ছে না দেখে আমি সেদিন গেলাম অজয়ের পিসির বাড়ি। সদর দরজা দিয়ে ঢোকামাত্রই টের পেলাম ভিতরে কোনো কারণে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলছে। কারণটা জানতে অজয়কে না ডেকে ধীরে ধীরে ওর পিসির বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করলাম।
অনেক চেষ্টা করে শেষে বোঝা গেল, কালুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলছে। সদরের পশু চিকিৎসালয় থেকে কম্পাউন্ডার এসেছে। কালুর চার পায়ে ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র লাগানো হয়েছে। ওকে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন দেবার জন্য তিনটে নার্স লাফালাফি করছে। কালুর খাবার তৈরি করছে ওদের রাঁধুনি পিসি। যে সে খাবার কালু খায়না। কুকুরের মুখ আঁকা একটা প্যাকেট নিয়ে রাঁধুনি পিসি ব্যতিব্যস্ত। ইঞ্জেকশান দিলেই কালু খিদের চোটে যাকে তাকে কামড়ে দিতে পারে এই কথা অজয় রাঁধুনি পিসিকে বার বার বলছে। কালুর খাবার বানানোর কৌশল খাবারের প্যাকেটের গায়ে লেখা আছে। অথচ রাঁধুনি পিসি পড়ালেখা জানেনা। তাই হাতে বাটি আর প্যাকেট নিয়ে তিনি এর ওর কাছে গিয়ে প্যাকেটের গায়ে কী লেখা আছে তা পড়ে দিতে বলছেন। আমার কাছে আসা মাত্র দেখলাম লেখা আছে ডিম শুকনো, মাংস আর হাড় গুঁড়ো, সয়াবিন গুঁড়ো… এই অব্ধি পড়তে পেরেছি; এমন সময় আমাকে ঠেলে একজন ডায়াগোনস্টিক সেন্টারের লোক ঢুকে কুকুরের বিষ্টা আর মূত্র সংগ্রহের জন্য উঠোনময় ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিল। কোন বিষ্ঠাটি সকালের প্রথম বিষ্ঠা সেটি জানার জন্য উপস্থিত সকলকে জিজ্ঞেস করছিল লোকটা।
খাদ্য বানানোর কৌশল পড়ে ওঠার আগেই বাইরে অ্যাম্বাসাডার দাঁড়ানোর ‘ঘ্যাচ’ শব্দ হল। পিসেমশাই এলেন চারচাকা চেপে। গাড়ি থেকে নেমে পিসেমশাই-এর উঠোন অব্ধি পৌঁছাতে যা সময় লাগলো, তারই মধ্যে উঠোনের সবাই অজয়ের আর পিসির নির্দেশে নিচের কোনো না কোনো ঘরে ঢুকে গেল। আজ নাকি পিসেমশাই-এর রাজধানী যাবার কথা ছিল। কাল বাদ পরশু ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ট্রেন ক্যানসেল হওয়ায় ফিরে এসেছেন। এদিকে কালুর খিদে বাড়ছে। আর অজয়ের মেজাজ।
আমি লুচির প্রথম গ্রাসটা মুখে পুড়ে নীরবতা ভঙ্গ করলাম, হ্যাঁরে কালুকে রাখিস কোথায়?
অজয় বেশ মেজাজের সঙ্গেই বলল, কালুতো আর আমার একার সম্পত্তি পাহারা দেবে না? পরিবারের সকলের সম্পত্তির নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে। সুতরাং ওকে রাখার দায়িত্ব পরিবারের সকলের। তাছাড়া ভবিষ্যতে কালুর ছেলেপুলে হবে, তাদের কথাও মাথায় রেখে আমি পিসিকে একটা গোয়াল বানানোর প্রস্তাব পিসেমশাইকে দিতে বলেছি।
—গোয়াল?
—ওই একই হল। গরুদের গোয়াল আর কুকুরদের…
সঠিক শব্দটা সেই মুহূর্তে খুঁজে পেল না অজয়। তাতে অসুবিধা নেই। অজয়কে স্বস্তি দিতে আমি পরবর্তী প্রশ্ন করলাম, তুইও কি বড়োলোক হতে শুরু করে দিয়েছিস? না মানে, এখন থেকে সম্পত্তি রক্ষার কথা ভেবে কালুকে রাখছিস, তাই বললাম।
—আলবাত, বড়োলোক হয়ে উঠছি।
আমি লুচি খাওয়া থামিয়ে প্রশ্ন করলাম, পাথরের ব্যবসা শুরু করে দিলি? মানে নাইনের বাৎসরিক পরীক্ষা দিবি না?
—ব্যবসা এখনো শুরু করিনি। তবে ব্যবসার জন্য মেটিরিয়াল মজুত করতে শুরু করে দিয়েছি। আর তারজন্যই কালুকে আমার খুব প্রয়োজন। আমার মেটিরিয়াল মজুতের কথা যদি একবার চোরেদের কানে যায় তবে আমার বড়োলোক হওয়ার দফারফা।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে সেদিনের মতো মানে মানে চলে এলাম। অন্যান্য বন্ধুদের ঘটনাটা বলতেই একে একে সকলে যেতে লাগলো অজয়দের বাড়ি। কিন্তু প্রত্যেকেই ফিরে এসে একই কথা জানালো। অজয় বলেছে, সে বড়োলোক হবার জন্য ব্যবসা করবে। আর তারজন্যই ব্যবসার মাল মেটিরিয়াল মজুত করতে শুরু করে দিয়েছে।
দেখতে দেখতে ডিসেম্বর মাস এসে গেল। আর মাত্র কয়েকমাস পর জীবনের প্রথম বোর্ডের পরীক্ষা। বাড়িতে দিন-রাত পড় পড় শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। অঙ্কের স্যারের কানমোলা আর ইতিহাসের স্যারের সাল-তারিখের লিস্ট দেখে মাঝে মাঝেই আমরা কেউ না কেউ ডিশিসান নিচ্ছি মাধ্যমিকের আগেই নিরুদ্দেশ হব। ঠিক এমন সময় আমাদের নেব নেব ডিশিসানটা সত্যি সত্যি নিয়ে নিল অজয়।
টেস্ট পরীক্ষার আগেই উধাও। স্কুল থেকে চিঠি গেল অজয়ের পিসিমার কাছে। কোনো উত্তর এল না। স্কুল থেকে লোক পাঠানো হলে জানা গেল, অজয়ের মা খুব অসুস্থ। তাই মায়ের সুশ্রূষার জন্য অজয় বাড়ি গেছে। মা সুস্থ না হলে ফিরবে না জানিয়ে, অজয় পিসিমাকে চিঠি লিখেছে। অজয়কে মাধ্যমিক দিতে হচ্ছে না শুনে আমাদের সকলের মনে বেশ রাগ হল, আবার দুঃখও। অজয়ের পিসিমার বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেই অজয়ের কথা খুব মনে পরতো। আর মনে মনে অজয়ের মায়ের দ্রুত সুস্থতা কামনা করতাম।
মাধ্যমিক শেষ হল। পরীক্ষা যেমন হওয়ার তেমনই হল সকলের। অন্য স্কুলে সীট। অন্য মাস্টারমশাইরা গার্ড দিলেন। বাড়িতে পরীক্ষা পরীক্ষা টেনশান। সবসময় পড়া পড়া ভয়। সব নিয়ে পরীক্ষা শেষ হল। তারপর তি-ন মাসের ছুটি। এই ছুটির মধ্যেই এ্ল রামযাত্রা। আমাদের পাড়ায় রাম ঠাকু্রের পুজো হতো চৈত্র মাসের রামনবমীর দিন। পরের দিন রাম ঠাকুরের বিসর্জন হতো। সেই উপলক্ষে পাড়ার রামতলা মাঠে কতো কী হতো। মেলা বসতো। নিলাম হতো। রাম ঠাকুরের বিসর্জনের আগে যখন প্রশেসানের জন্য ঠাকুর সাজানো চলতো তখন মাঠের একদিকে হতো নিলাম। সবশেষে হতো রাম ঠাকুরকে বিসর্জনের জন্য লরিতে বসিয়ে গঙ্গার উদ্দেশে রামযাত্রা।
আমি বললাম, তা কীকরে হবে? কালুকে তো অজয় সঙ্গে নিয়ে গেছে। চারপাশের লোকের তাড়া খেয়ে কুকুরটা পালালো। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল নিলাম। নিলাম শুরু হওয়া মাত্রই ভিড় উপচে পড়ছিল মাঠের এইদিকটায়। অন্যদিকে নাগোর দোলা, ফুচকা-ঘুগনি-চুরমুরের স্টল আর প্রশেসানের জন্য লরি সাজানো হচ্ছিল।
নিলাম জমে উঠতে আমরা চপ মুড়ির ঠোঙা নিয়ে স্টেজের সামনে লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে গেলাম। ফল মূল কাপড় গামছা ধূপের নিলাম ডাকা শেষ হলে ঠাকুরের জন্য কেনা ইমিটেশনের গয়নাও প্রতি বছর নিলাম হতো। সেগুলো কিনতো মূলত কলোনির মেয়েরা। নিলাম বনাম বেচাকেনা বেশ চলছিল মসৃণ ভাবেই। নিলামের অ্যানাউসার এমন সময় হাতে একটা নীল পাথরের লকেট সমেত চেন তুলে দাম ঘোষণা করল।
লকেটের নীল পাথরটা এতই আকর্ষণীয় ছিল যে, ঘোষণা মাত্রই মুহূর্তের জন্য সবাই স্তম্ভিত হয়ে বেশ খানিকক্ষণ দূর থেকে পাথরটাকে দেখল। এরপর শুরু হল নিলাম ডাকা। ডাক ১০ টাকা থেকে শুরু হল, ক্রমে ১০০ টাকা ২০০ টাকা এমনকি ৫০০ টাকাও ডাকল একজন। ৫০০ টাকা এক, ৫০০ টাকা দুই ৫০০ টাকা তিন এই ভাবে ডাক এগোচ্ছিল। এক ঝটকায় কে যেন ডাকল ১০০০ টাকা। ১০০০ টাকা একটা ঝুটো চেন লকেটের দাম শুনে সবাই মুহূর্তের জন্য চুপ মেরে গেল। কিন্তু অনেক খুঁজেও ভিড়ের থেকে ১০০০ টাকা ডাক যে দিয়েছিল তাকে কেউ খুঁজে পেল না। এবার যে ৫০০ টাকা ডেকেছিল তার খোঁজ শুরু হল। কিন্তু নিলাম ডাকছিল যে অর্থাৎ শিবশঙ্কর চৌবে সে বেশ রেগে গেল। এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে রব উঠল, পালাচ্ছে পালাচ্ছে।
—কে পালাচ্ছে? অনেক অনুসন্ধানের পর জানা গেল, যে ১০০০ টাকা ডেকেছিল সে। ভিড় ঠেলে, একে ফেলে, ওকে কান মুলে, তিনি মুহূর্তে আমরা যে লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই পোস্টটায় বাঁদরের মতো উঠে গেলেন, চাদর মুড়ি দিয়ে। ভিড়ের ঠেলায় আমরাও এ ওর ঘাড়ে পড়লাম, ও এর চুলির মুঠি ধরলাম, সে তার গায়ে খামচি মারলাম। আমি তো পড়েই যাচ্ছিলাম, আমাকে কে যেন চুলের মুঠি ধরে টেনে সোজা করল। এই অন্ধকারে কারা যেন ককিয়ে উঠল। স্টেজ থেকে মাইকে শিবশঙ্কর চৌবে বলছেন, ধর ব্যাটাকে,ধর। আর ধর। তিনি তো তখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর এই হুড়োহুড়িতে আমার বুক পকেট থেকে সাইকেলের চাবিটা গেল পড়ে। সেটা তুলতে যাব এমন সময় কারেন্ট গেল চলে। একটা বিকট আওয়াজ করে নাগোরদোলা থেমে গেল। অন্ধকারে ভিড়ের সকলে আর্তনাদ করে উঠল।
এই হুলুস্থুলু অবস্থা রইল প্রায় মিনিটে দশেক। ধীরে ধীরে মাঠের একপ্রান্তে দাঁড়ানো হ্যাজাকগুলো মাঠের সব দিকে ছড়িয়ে গেল। একটা আলো আঁধারি অবস্থা সৃষ্টি হতেই যা দেখলাম তাতে কেউ আশ্চর্য না হলে অবাকই হব। যে লোকটা বিশাল মই লাগিয়ে ঠাকুরের গায়ের গয়না খুলছিল সে হুড়োহুড়িতে মই নিয়ে পড়েছে। সেই মই এর চাপে কয়েকজন রক্তারক্তি।
তাতেও নেমে আসছে না দেখে ,রাঁধুনি পিসি শিবশঙ্কর চৌবের উদ্দেশে বলছেন, অজু ঝোঁকের মাথায় ১০০০টাকা হেঁকে দিয়েছে । ওকে তোমরা ছেড়ে দাও। ও গরীবের ছেলে। পরের ঘরে মানুষ হচ্ছে। ওর কাছে অত টাকা কোথায়?
পাশ থেকে অনেকে বলছে, হ্যাঁ, পুলিশে খবর দে। কেউ বলছে ফায়ার ব্রিগেডে ফোন কর। কেউ বলছে, পঞ্চুদের বাড়ি থেকে ওর বাবার মাছ ধরার জালটা নিয়ে আয়।
ভিড়টা ক্রমশ লাইটপোস্টের নিচে বাড়তে থাকায় আমরা ভিড়ের ঠেলায় দূরে সরে যেতে থাকলাম আর আমার সাইকেলের চাবি পাবার শেষ আশায় জল ঢেলে সন্টি আমাকে হ্যাঁচকা টানে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। দু’জন স্বেচ্ছাসেবক পড়ে যাওয়া মই তুলে লাইট পোস্টের গায়ে লাগিয়ে উঠে জানাল পোস্টে কেউ নেই। ঠিক এমন সময়, কারেন্ট চলে এল।
ঝলমলে আলোয় দেখলাম, একটা মেয়ে তার ফর্ক ছিঁড়ে গেছে বলে কাঁদছিল। তার মা তাকে হাত ধরে টানতে টানতে ভিড় থেকে বার করতে করতে বলল, অনেক হয়েছে। আর আসবি মেলায়?
এম্বুলেন্সের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। মুহূর্তে দু’জন লোক মাথার উপর তুলে স্টেচার নিয়ে ভিড়ে ঢুকে পড়ল। স্টেচার যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাঁধুনি পিসি হাইড্রেনে পড়ে গেছে। পড়েই সেনসেলস। তাকে টেনে স্টেচারে তোলার চেষ্টা চলছে। সবচেয়ে করুণ অবস্থা পুরুৎ মশাইএর। তাঁর মাথার টিকি কোন মহিলার কানের দুলে আঁটকে গেছে। অন্ধকারে মহিলার টানে তারই কাঁধে মাথা রেখে তিনি ঘুরপাক খেয়েছেন। কারেন্ট আসতে মহিলার বাড়ির লোকের সহায়তায় দুল আর টিকির জট ছাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
আমরা কিন্তু একটু বাদে আবার লাইটপোস্টের তলায় গেলাম। প্রথম উদ্দেশ্য সাইকেলের চাবি খোঁজা। দ্বিতীয় অজয়কে লাইট পোস্ট থেকে নামানো। সন্টির চার ব্যাটারির টর্চের আলোয় দেখলাম অজয় তখন লাইট পোস্ট থেকে পাশের হেলানো খেজুর গাছে আশ্রয় নিয়েছে। দেখেও না দেখার ভান করলাম। কারণ প্রথমত অজয় আমাদের বন্ধু, দ্বিতীয়ত খেজুর গাছ থেকে নামা চাট্টিখানি কথা নয়।
অনেক রাতে রাম ঠাকুর নিয়ে বিসর্জনের জন্য বের হল সকলে। আমরা লাইট পোস্টের তলা থেকে একদম নড়লাম না। ভিড় পাতলা হলে অজয় খেজুর গাছ থেকে আবার লাইটপোস্টে এসে নেমে এল। মুখে সেই চেনা দেঁতো হাসি। আমি কিন্তু তখনো খানিক মেঠো ধুলো মুঠিতে তুলছি আর বলছি, উড়ো ধুলো গোবিন্দায় নমঃ। এত করেও আমার সাইকেলের চাবি অবশ্য পাওয়া গেল না। সে নিশ্চয়ই ততক্ষণে দর্শকদের পদধূলিতে মিশে রাম ঠাকুরের সঙ্গে গঙ্গার দিকে যাত্রা করেছে।
সাইকেলের পিছন চাকা তুলে বাড়ির দিকে যেতে যেতে অজয়কে জিজ্ঞেস করলাম, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছিল? একটা ঝুটা পাথরের জন্য ১০০০টাকা হাঁকলি?
অজয় সবাইকে অবাক করে বলে কিনা, আমি তো বেশ অনেক দিন ধরেই ঝুটা পাথর জমানো শুরু করেছি রে। ঝুটা নীলা, ঝুটা পান্না, ঝুটা প্রবাল। ওসবের এখন খুব ডিম্যান্ড। দেখবি একদিন আমি ঝুটা পাথরের ব্যবসা করে কত বড়োলোক হবো।
সন্টি এবার রেগে বলল, এটা তোর একটা ডিজিজ অজয়।
আমি বললাম, ডিজিজ বলছিস কেন। প্রতিটা মানুষের মধ্যেই বিশেষত্ব থাকে। এটাই অজয়ের বিশেষত্ব। ওর বড়োলোক হওয়া এই টেনাসিটির জন্যই কেউ আটকাতে পারবে না।
এইসময় অজয়ের পাশে পাশে কালুও এসে গেল। দু’জনে অন্ধকারে পিসির বাড়ির দিকে চলে গেল। অবাক কথা পরেরদিন থেকে আবার অজয়ের টিকিটিও কেউ দেখল না।
অবাক হবার এখানেই শেষ নয়। এর বেশ কিছুদিন পর কাগজে নিরুদ্দেশ কলামে অজয়ের ছবি দিয়ে লেখা হল। “অজয় তুমি যেখানেই থাকো চলে এসো। তোমার পিসি অসুস্থ। তোমার ভয় নেই। শিবশঙ্কর চৌবে তোমার পিসেমশাইকে জানিয়েছেন, কোন মূল্য ছাড়াই সেই নীল পাথরের লকেট তোমাকে দান করবেন।”
এবার বাছাধন যায় কোথায়, পাথরের লোভে গুটি গুটি হাজির। পাথরের ব্যবসা করে বড়োলোক হবার শখ তখনও যে তার ষোলোয়ানা বজায় ছিল।
মৌসুমী ঘোষ
জেলাঃ পশ্চিম মেদিনীপুর
