rupkatha-png
সততা, নীতিবোধ ও রাজধর্ম নিয়ে চাণক্যের গল্প

চাণক্য (বা কৌটিল্য) ছিলেন প্রাচীন ভারতের একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও রাজনীতিক উপদেষ্টা, যিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর রচিত "অর্থশাস্ত্র" একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ, যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি ও নৈতিকতা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি পাওয়া যায়।

সততা, নীতিবোধ ও রাজধর্ম নিয়ে চাণক্যের গল্প

১. চাণক্য ও চোরের গল্প

একবার চাণক্য তাঁর শিষ্যদের নীতিশিক্ষা দিচ্ছিলেন। এমন সময় একজন চোরকে ধরে আনা হলো, যে রাজপ্রাসাদ থেকে মূল্যবান মণি চুরি করেছিল। রাজদরবারে সবাই চোরের শাস্তির দাবি করল। চাণক্য বললেন, "এই চোরকে মুক্ত করে দাও।" সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "কেন? সে তো অপরাধী!" চাণক্য উত্তর দিলেন, "এই ব্যক্তি শুধু একটি মণি চুরি করেছে, কিন্তু যারা রাজকোষ থেকে করের টাকা আত্মসাৎ করে, তারা লক্ষ গুণ বড় চোর। তাদের প্রথমে শাস্তি দাও।" নীতি:

  • ছোট অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার আগে বড় দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন।
  • রাজ্যের শাসকদেরই প্রথমে ন্যায়বান ও সৎ হতে হবে।


২. সত্যের মূল্য

একদিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য চাণক্যকে প্রশ্ন করলেন, "গুরুদেব, রাজ্যের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী?" চাণক্য একটি সাধারণ ইট এনে বললেন, "মহারাজ, এটি বিক্রি করে দেখুন।" চন্দ্রগুপ্ত ইটটি নিয়ে বাজারে গেলেন, কিন্তু কেউ কিনতে চাইল না। তারপর চাণক্য তাকে একটি সোনার মুদ্রা দিয়ে বললেন, "এটি বিক্রি করুন।" চন্দ্রগুপ্ত সেটি সহজেই বিক্রি করে এলেন। অবশেষে চাণক্য বললেন, "মহারাজ, ইট এবং সোনা—দুটোরই নিজস্ব মূল্য আছে। কিন্তু সততা ও ন্যায়পরায়ণতা হলো এমন সম্পদ, যার কোনো মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। রাজধর্ম হলো সততার পথে চলা, কারণ এটি রাজ্যের ভিত্তি।" নীতি:

  • সততা ও ন্যায়বিচারই রাজ্যের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।
  • অর্থ বা ক্ষমতার চেয়ে নৈতিক মূল্যবোধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।


৩. রাজধর্ম ও প্রজার কল্যাণ

একবার চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জিজ্ঞাসা করলেন, "রাজার প্রধান কর্তব্য কী?" চাণক্য উত্তর দিলেন, "রাজার ধর্ম (রাজধর্ম) হলো প্রজাদের রক্ষা করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং দুর্নীতি দূর করা। যে রাজা শুধু নিজের সুখ চায়, সে ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু যে রাজা প্রজাদের কল্যাণে নিবেদিত, তার রাজ্য চিরস্থায়ী হয়।" নীতি:

  • প্রকৃত শাসনক্ষমতা হলো সেবা।
  • রাজ্য চালানোর জন্য কঠোর নীতি ও নৈতিকতা প্রয়োজন।


চাণক্যের বিখ্যাত উক্তি

  • "অসৎ ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করো না, কারণ সে দুঃসময়ে তোমাকে বিক্রি করে দেবে।"
  • "সৎ লোকের ধন হলো তার চরিত্র, কিন্তু দুষ্টের ধন হলো সোনা-রূপা।"
  • "রাজা নিজে যদি নীতিহীন হয়, তাহলে সমগ্র রাজ্যই নষ্ট হয়ে যাবে।"

চাণক্যের শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ তা শাসক ও নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁর মতে, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও দায়িত্ববোধই হলো প্রকৃত রাজধর্ম।

চাণক্য কেন আজও প্রাসঙ্গিক?

রুট লেভেল থেকে পরিবর্তন: তিনি শাসক থেকে সাধারণ মানুষ—সবার জন্য নৈতিক আচরণবিধি রেখেছিলেন।

 

প্র্যাকটিক্যাল নীতি: তাঁর উপদেশ শুধু আদর্শিক নয়, বাস্তবায়নযোগ্য (যেমন: দুর্নীতিবাজদের শাস্তি, স্বচ্ছতা)।

 

সমাজের মেরুদণ্ড: ন্যায়বিচার, সততা ও দায়িত্ববোধ ছাড়া সমাজ পঙ্গু হয়ে যায়—এটি আজকের বাংলার জন্য সতর্কবার্তা।

 

কীভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে?

শিক্ষা ব্যবস্থায়: চাণক্যের নীতিশিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।

 

রাজনৈতিক সংস্কার: দুর্নীতিবিরোধী কঠোর নীতি (চাণক্যের মতো "জিরো টলারেন্স")।

 

সামাজিক আন্দোলন: নৈতিকতা ও নাগরিক দায়িত্ব নিয়ে গণসচেতনতা তৈরি।

 

মূল কথা: চাণক্য কঠোর, কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে। আজকের বাংলার অস্থিরতা, হতাশা ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে তাঁর দর্শন এক শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।