rupkatha-png
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এর সমন্ধে কিছু গল্প

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (Ernest Hemingway) ছিলেন একজন বিখ্যাত আমেরিকান লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি ২০শ শতাব্দীর সাহিত্যে গভীর প্রভাব রেখেছিলেন। তাঁর জীবন ছিল ঘটনাবহুল এবং রোমাঞ্চকর। তাঁর লেখার পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও বেশ চাঞ্চল্যকর ছিল। এখানে তাঁর সম্পর্কে কিছু গল্প ও ঘটনা উল্লেখ করা হলো:

১. যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এবং আহত হওয়া:

হেমিংওয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রেড ক্রসের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসেবে ইতালিতে কাজ করেছিলেন। ১৯১৮ সালে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন যখন একটি অস্ট্রিয়ান শেল বিস্ফোরণে তাঁর পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অভিজ্ঞতা তাঁর পরবর্তী লেখায় গভীর প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে তাঁর উপন্যাস "A Farewell to Arms" (১৯২৯)।

 

২. স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার এবং "ফর হুম দ্য বেল টোলস":

হেমিংওয়ে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় স্পেনে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি সাংবাদিকতা করেছিলেন। এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাঁর উপন্যাস "For Whom the Bell Tolls" (১৯৪০)-এর ভিত্তি তৈরি করে। এই উপন্যাসটি যুদ্ধের নৃশংসতা এবং মানবিক সংঘাতের গভীর চিত্র তুলে ধরে।

 

৩. আফ্রিকান সাফারি:

হেমিংওয়ে আফ্রিকায় শিকারে গিয়েছিলেন এবং এই অভিজ্ঞতা তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর ছোটগল্প "The Snows of Kilimanjaro" এবং "The Short Happy Life of Francis Macomber" আফ্রিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শিকারের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা।

 

৪. কিউবার সাথে সম্পর্ক:

হেমিংওয়ে কিউবায় অনেক বছর কাটিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "The Old Man and the Sea" (১৯৫২) লেখেন। এই উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কিউবার ফিঙ্কা ভিজিয়া (Finca Vigía) ছিল তাঁর প্রিয় বাসস্থান।

 

৫. মদ্যপান এবং সাহিত্যিক জীবন:

হেমিংওয়ে তাঁর মদ্যপানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি প্রায়ই বার এবং ক্যাফেতে সময় কাটাতেন, যেখানে তিনি অন্যান্য সাহিত্যিক এবং শিল্পীদের সাথে আলোচনা করতেন। প্যারিসের "লস অ্যামগোস" (Lost Generation) সাহিত্যিক গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তিনি জেমস জয়েস, এফ. স্কট ফিট্জেরাল্ড এবং গারট্রুড স্টাইনের মতো ব্যক্তিত্বদের সাথে মেলামেশা করতেন।

 

৬. আত্মহত্যা:

হেমিংওয়ের জীবন শেষ হয় আত্মহত্যার মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে তিনি শটগান দিয়ে নিজেকে গুলি করেন। তাঁর আত্মহত্যার পেছনে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে বিষন্নতা এবং মদ্যপানের প্রভাব ছিল বলে ধারণা করা হয়।

 

৭. লেখার শৈলী:

হেমিংওয়ের লেখার শৈলী ছিল সরল এবং শক্তিশালী। তিনি "আইসবার্গ তত্ত্ব" (Iceberg Theory) অনুসরণ করতেন, যেখানে লেখার মধ্যে শুধু প্রয়োজনীয় তথ্যই দেওয়া হয় এবং গভীর অর্থ পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এই শৈলী তাঁকে সাহিত্য জগতে অনন্য করে তুলেছে। হেমিংওয়ের জীবন এবং কাজ সাহিত্য প্রেমীদের জন্য আজও অনুপ্রেরণামূলক। তাঁর রচনাগুলো মানবিক আবেগ, সংগ্রাম এবং প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের গভীরতা তুলে ধরে।

 

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছিলেন এক বিস্ময়কর লেখক, যিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর লেখনীর জন্য বিখ্যাত। তাঁর কিছু অসাধারণ গল্প সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:

১. "The Old Man and the Sea" (বৃদ্ধ ও সমুদ্র)

এটি হেমিংওয়ের সর্বাধিক বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে একটি। গল্পটি একজন বৃদ্ধ মৎস্যজীবী সান্তিয়াগোর সংগ্রামের কাহিনি, যিনি ৮৪ দিন মাছ ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পর এক বিশাল মার্লিন মাছ ধরেন। কিন্তু সমুদ্রযাত্রায় হাঙ্গর সেই মাছটি ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। এই গল্পে মানুষের অধ্যবসায় ও একাকীত্বকে চিত্রিত করা হয়েছে।

২. "A Clean, Well-Lighted Place"

এই ছোটগল্পটি দুই ওয়েটারের মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে, যারা এক বৃদ্ধ মাতালকে নিয়ে আলোচনা করছে। এক তরুণ ওয়েটার বৃদ্ধটিকে দ্রুত বিদায় করতে চায়, কিন্তু প্রবীণ ওয়েটার তার প্রতি সহানুভূতিশীল। গল্পটি নিঃসঙ্গতা, হতাশা ও জীবনের অর্থহীনতা নিয়ে লেখা।

৩. "Hills Like White Elephants"

এই গল্পটি এক তরুণ দম্পতির মধ্যে হওয়া গোপন সংলাপের মাধ্যমে গঠিত, যেখানে তারা গর্ভপাত নিয়ে আলোচনা করছে। হেমিংওয়ে তাঁর বিখ্যাত "আয়সবের্গ থিওরি" ব্যবহার করেছেন—গল্পে সরাসরি কিছু বলা হয়নি, কিন্তু পাঠক সংলাপের মাধ্যমে গভীর অর্থ খুঁজে নিতে পারেন।

৪. "Indian Camp"

এই গল্পে হেমিংওয়ের জনপ্রিয় চরিত্র নিক অ্যাডামস প্রথমবারের মতো আসে। নিক তার বাবার সাথে একটি ভারতীয় ক্যাম্পে যায়, যেখানে তার ডাক্তার বাবা এক ভারতীয় মহিলার প্রসব করাতে সাহায্য করে। এটি নিকের জন্য এক ধরনের পরিণতির গল্প, যেখানে সে প্রথমবারের মতো জন্ম ও মৃত্যুর বাস্তবতা বোঝে।

৫. "The Short Happy Life of Francis Macomber"

এটি এক দম্পতির আফ্রিকান সাফারির কাহিনি, যেখানে স্বামী ফ্রান্সিস তাঁর সাহসিকতা প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু তার স্ত্রী তার সাহসিকতার অভাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এবং শেষ পর্যন্ত এক রহস্যময় পরিস্থিতির মাধ্যমে গল্পটি শেষ হয়।

৬. "Soldier’s Home"

এই গল্পটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা এক সৈনিকের মানসিক পরিবর্তন এবং সমাজের সাথে তার বিচ্ছিন্নতা তুলে ধরে। হেমিংওয়ে এখানে যুদ্ধের মানসিক প্রভাব ও পুনর্বাসনের জটিলতা ফুটিয়ে তুলেছেন।

হেমিংওয়ের গল্পগুলো সাধারণত সংক্ষিপ্ত, বাস্তববাদী ও মনস্তাত্ত্বিক গভীরতায় ভরা।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি হলো মাত্র ছয়টি শব্দের একটি গল্প। এটি একটি মাইক্রোফিকশন বা ফ্ল্যাশ ফিকশনের উদাহরণ, যা গল্প বলার ক্ষেত্রে হেমিংওয়ের দক্ষতা এবং সংক্ষিপ্ততার প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করে।

গল্পটি হলো: "For sale: baby shoes, never worn." (বাংলায়: "বিক্রির জন্য: শিশুর জুতা, কখনো পরা হয়নি।") এই ছয়টি শব্দে হেমিংওয়ে একটি গভীর এবং মর্মান্তিক গল্প বলেছেন। গল্পটি পাঠকের মনে একটি শক্তিশালী আবেগ তৈরি করে, যা একটি সম্ভাব্য ট্র্যাজেডি বা হারানোর বেদনাকে ইঙ্গিত করে। এটি হেমিংওয়ের "আইসবার্গ তত্ত্ব" (Iceberg Theory)-এর একটি চমৎকার উদাহরণ, যেখানে লেখার মধ্যে শুধু প্রয়োজনীয় তথ্যই দেওয়া হয় এবং গভীর অর্থ পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়।

এই গল্পটি সাহিত্য জগতে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং এটি সংক্ষিপ্ত গল্প লেখার ক্ষেত্রে একটি আইকনিক উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।